পাট পচনে পানির ঘাটতি সমাধানে মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম একটি বিকল্প উদ্ভাবনী প্রযুক্তি
ড. জাকারিয়া আহমেদ
পাটের কা-ের কাঠের অ-তন্তুযুক্ত (পেকটিন ও অন্যান্য মিউকিলাজিনাস) পদার্থ থেকে আঁশগুলোকে আলাদা করার প্রক্রিয়াকে পাট পচন বা রেটিং বলা হয়। এটি একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন আঁশ গ্রুপের জীবাণুর ক্রিয়া দ্বারা সঞ্চালিত হয়। পাট পচনের সময় বাংলাদেশের কিছু এলাকা বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে, পানির অভাব দেখা দেয়। এ কারণে মৌসুমে পাট কাটার তীব্র সংকটে পড়ে কৃষকরা। পাটের সবুজ আঁশ শুকিয়ে সংরক্ষণ করে, পরে যদি শুকনো ছাল থেকে একই মানের আঁশ পাওয়া যায় তবে শুকনো বা সংরক্ষিত আঁশগুলো চাষের জন্য সহায়ক হতে পারে এবং পানির অভাবজনিত সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান করা যায়। সাধারণত ধীরগতিতে চলমান পানিতে পাট পচন করা সবচেয়ে ভালো। স্থির পানিতে নিকৃষ্ট মানের আঁশ উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকে, যদি না প্রতিবার পচন করার পর বিশুদ্ধ পানি এবং জীবাণুর জন্য অনুকূল ব্যবস্থা করা হয়। এই সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে, আঁশ পাওয়ার জন্য অণুজীব ইনোকুলাম/কনসোর্টিয়া ব্যবহার একটি বিকল্প পাট পচন কৌশল হতে পারে।
অণুজীব (মাইক্রোবিয়াল) ইনোকুলাম/কনসোর্টিয়া হলো জীবম-লজুড়ে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংমিশ্রণ। এই অণুজীবগুলো বিভিন্ন উৎস থেকে আসতে পারে এবং তাদের এনজাইম উৎপাদন ক্ষমতার ভিত্তিতে অণুজীব (মাইক্রোবিয়াল) ইনোকুলাম/কনসোর্টিয়া প্রণয়ন করা যেতে পারে। এই ইনোকুলামগুলো শুকনো বা সংরক্ষিত ছালের উপর প্রয়োগ করা যেতে পারে। মাইক্রোবিয়াল ফর্মুলেশন শুধুমাত্র পাট পচন এর সময়কাল কমানোর জন্যই নয় বরং আঁশ/ফাইবারের মানের অন্তত দুই থেকে তিন গ্রেডের উন্নতির জন্যও উপযুক্ত বলে মনে করা হয় ।
অতএব, মাইক্রোবিয়াল কনসোর্টিয়া ব্যবহার করে সংরক্ষিত বা শুকনো পাটের ছাল থেকে রেটিং/ফাইবার নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার বিকাশের জন্য পানির অভাব এলাকায় বা পানির অভাবের সময় পাটের বিকল্প কৌশল হতে পারে। ইনোকুলাম ফর্মুলেশন এবং ডেভেলপমেন্ট হলো একটি সুপ্ত স্টক কালচার থেকে অণুজীবের জনসংখ্যার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অণুজীবের একটি জনসংখ্যা প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া, যা একটি চূড়ান্ত উৎপাদনশীল পর্যায়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ধারণাটি শুধুমাত্র অণুজীবের ইনোকুলামের বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রেই নয়, বরং বিশুদ্ধ অণুজীবের বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নি¤েœাক্ত কৌশল পাট কাটার জন্য পানির অভাবের একটি চমৎকার প্রযুক্তি :
আঁশ সংগ্রহের জন্য মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম তৈরি করে দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণ করা সম্ভব এবং পাট পচন মৌসুমে পানির স্বল্পতা পরিলক্ষিত হলে, পাট চাষি মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম সংগ্রহকৃত পাটে খুব সামান্য পানিতে ছিটানো মাধ্যমে পাট আঁশগুলোকে সহজেই আলাদা করতে সক্ষম হবে।
লাইফোলাইজেশন (শুষ্ক সুপ্ত মাইক্রোবিয়াল পাউডার) কৌশল ব্যবহার মাধ্যমে পাউডার আকারে মাইক্রোবিয়াল কনসোর্টিয়ার তৈরি করে প্যাকেটজাত অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণ করা সম্ভব এবং প্রয়োজনে পানির স্বল্পতা এলাকায় পাট বা পাটের রিবন থেকে আঁশ সংগ্রহ করতে সহায়তা করবে।
পাট পচনের উপযুক্ত মাইক্রোবিয়াল এনজাইমগুলোকে নির্বাচন করে, নির্বাচিত এনজাইমের বিট বা গুটি (এনজাইমের আধার) তৈরি করা সম্ভব, যা পাটের বা পাটের রিবন থেকে আঁশ সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনে বারবার ব্যবহার করা যেতে পারে।
অতএব, যেহেতু মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম (বোতলজাত অবস্থায়), লাইফোলাইজড মাইক্রোবিয়াল কনসোর্টিয়া (প্যাকেটজাত অবস্থায়) বা এনজাইমের বিট (প্যাকেটজাত অবস্থায়) দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণ করা যায়; তাই এইগুলোকে কৃষকদের মাঝে বিপণনের মাধ্যমে পানির অভাবজনিত পাট পচন সমস্যা অনেকাংশে কাটিয়ে উঠা সম্ভব। এই অভিনব কৌশল পাট চাষিদের, তথা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরির মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করবে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা ১২০৭, বাংলাদেশ। মোবাইল : ০১৯৬৯৬৯৯৮৫১; ই-মেইল :zakaria.ahmed70@gmail.com